- বাংলাদেশের সকাল, মানুষের দিনযাপন আর স্মৃতির ভেতরের আলো—এই শীতে নতুন করে দেখা এক ঋতুর গল্প।
………
আমাদের দেশে শীতের আসা যেন কোনো দীর্ঘ যাত্রার শেষে ঘরে ফেরা অতিথির মতো। সব ঋতুর ভিড়ের মধ্যে শুধু শীতই আসলেই অচেনা এক আবহ তৈরি হয়। গরম তখনো পুরোপুরি বিদায় নেয় না, তবুও সকালে গা ছমছমে বাতাস বইলেই মনে হয় শীত খুব কাছে। আলমারির ভেতর যতদিন গরম কাপড় নিঃসঙ্গ পড়ে থাকে, প্রথম কুয়াশার পড়তেই আমরা সেগুলো ঝেড়ে-মুছে বের করে রাখি। মনে হয়, “এসে যাও শীত, তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।”
কিন্তু শীত যে শুধু ঠান্ডা নয়, এটা এক রহস্যময় অনুভব।
এক ভোরে বাইরে তাকালে দেখা যায় প্রকৃতি নরম ধূসর পর্দায় ঢাকা। সেই পর্দা কখনো পুরোটা দেখায় না, আবার লুকিয়েও রাখে না। এই অর্ধদেখা, অর্ধলুকানো পৃথিবী শীত ছাড়া আর কোনো ঋতু উপহার দিতে পারে না। মাঠের ঘাসে জমে থাকা শিশিরকে সূর্যের আলো ছুঁতেই যে ঝিলমিল ওঠে, সেই আলো যেন মনে করিয়ে দেয়, শীতের আগমন মানেই স্মৃতির আলমারিতে আলো জ্বলে ওঠা। শীত এমন এক ঋতু, যা আমাদের মনে একসঙ্গে জাগিয়ে তোলে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।
আমার কাছে শীত মানেই এক ধরনের অদ্ভুত নীরবতা। এ নীরবতার ভেতর লুকিয়ে থাকে ভাঙা–গড়া অসংখ্য অনুভূতি। সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত শূন্যতার জন্ম দেয়। যেমন কুয়াশায় ঢাকা রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয়-জীবনের পুরোনো গল্পগুলো যেন আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। অদৃশ্য স্মৃতিগুলো কাছে এলে বুকের কোথাও দায়হীন ব্যথা জন্মায়। যেন খুব চেনা মানুষেরা শীতের মতোই কিছু সময়ের জন্য আসে, তারপর আবার হারিয়ে যায়। আবার সেই শূন্যতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে উষ্ণতা খোঁজার আনন্দ।
শীতের গ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর চিত্রগুলো আঁকে। ভোরবেলায় খেজুর গাছ থেকে রস পড়ার টুপটাপ শব্দ, মাটির চুলায় পিঠা বানানোর সুবাস, উঠোনে জমে থাকা শিশুর হাসি, সব মিলিয়ে ছোট্ট উৎসবের মতো লাগে। শহরের মানুষও এসময় একটু বেশি চায়ের কাপে ডুবে থাকে, ফুটপাতে ধোঁয়া ওঠানো ভাপা পিঠা, ভাপ ওঠা ভুট্টা কিংবা গরম স্যুপে সন্ধ্যা হয় আরও নরম।
শীত মানেই স্মৃতির কাছে ফিরে যাওয়া। স্কুলের পথে কুয়াশা ভেদ করে হাঁটার সেই ছোটবেলার সকাল, বাবার হাত ধরে এগোনোর উষ্ণতা, এগুলো চোখ বন্ধ করলেই ফিরে আসে। আজ সেই শিশুটি বড় হয়েছে, দায়িত্ব বেড়েছে, জীবন বদলে গেছে। তবুও শীত এলেই মনে হয় জীবন থামুক কিছু সময়, একটু নতুন করে শুরু হোক।
শীত আসলে কোনো ঋতু নয় এক ধরনের সংগীত। যার সুর কখনো ভোরের আলোয়, কখনো স্মৃতির ভেতর, কখনো আবার পিঠার গন্ধে বাজে। এ সুর মানুষকে প্রতি বছর নতুনভাবে স্পর্শ করে, নতুনভাবে ভাবায়, নতুনভাবে জীবনকে দেখায়।
শীতের এই আবেগময় রূপের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের দৃশ্যগুলোও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশজুড়ে শীত পড়লেই মানুষের দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞে পরিবর্তন দেখা যায়, যা শহর থেকে গ্রাম, সব জায়গায় আলাদা আলাদা চিত্র তুলে ধরে।
ভোরের শহর পরিবর্তিত হয় শীতের চাপেই। ঢাকার ভোরে কুয়াশা নেমে আসতেই যানবাহনের গতি কমে যায়।
হেডলাইটের আলো ভেদ করেই রিকশা আর বাস এগোয় সতর্কভাবে। ফুটপাথে চায়ের দোকানদাররা চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিন শুরু করেন, আর প্রথম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে ভরসা খোঁজেন কর্মজীবী মানুষ। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য শীত মানে বাড়তি কষ্টও। ফুটপাথে থাকা মানুষ কিংবা নিম্নআয়ের পরিবারের অনেকেই পর্যাপ্ত গরম কাপড়ের অভাবে ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করেন। গরম কাপড়ের ফুটপাতের দোকানে দাম তুলনামূলক কম হলেও অনেকের জন্য তা এখনো ‘বিলাসিতা’।
গ্রামেও শীতের আলাদা কর্মযজ্ঞ চলে যেখানে সকালের বাজারে নতুন সবজির ভিড় সব মিলিয়ে গ্রামের শীতে কাজের চাপ আরও বাড়ে।
কৃষি বিভাগ জানায়, শীতকালেই দেশের মোট সবজির ৬০ শতাংশ বাজারে আসে। এই মৌসুমে সবজির দাম কমে, আর কৃষকদের আয় খানিকটা বাড়ে। তাই গ্রামের মানুষ শীতকে যেমন অনুভব করে, তেমনি শীত তাদের জীবিকাকেন্দ্রিক সময়ও।
বাংলাদেশের এই স্বল্পস্থায়ী শীত তাই শুধু কোনো ঋতু নয়, এটা মানুষের জীবনযাত্রার নরম পরিবর্তন, স্মৃতি জাগানো সকাল, আর বাস্তবতার সঙ্গে প্রতিদিনের সংগ্রামের এক নিঃশব্দ সহযাত্রী। কুয়াশার চাদর সরে গেলে যেমন দুপুরের রোদ ধীরে ধীরে আলো ফিরিয়ে আনে, তেমনি শীতও তার সময় শেষে মিলিয়ে যায় চিরচেনা নিয়মে। তবুও প্রতি বছর শীত ফিরে আসে নতুন প্রত্যাশা, নতুন গল্প আর নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে। ঋতুর এই আসা-যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের প্রতিটি পরিবর্তনই ক্ষণিকের, কিন্তু প্রতিটি দৃশ্যই রেখে যায় কিছু না কিছু উষ্ণতা।