পাকিস্তানের পারমাণবিক ছাতার নিচে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় আস্থার ঘাটতি ও ইরানকে ঠেকানোর প্রয়োজনে দেশটি এবার পাকিস্তানের পরমাণু প্রতিরক্ষার ছাতার নিচে অবস্থান নিয়েছে।
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) এক প্রবন্ধে একথা জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, দীর্ঘদিনের সামরিক সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে সৌদি আরব ও পাকিস্তান সম্প্রতি স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট (এসএমডিএ) স্বাক্ষর করেছে। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—“যে কোনও এক দেশের ওপর আক্রমণ মানেই উভয় দেশের ওপর আক্রমণ।”
একজন জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, এই পদক্ষেপ হঠাৎ নেওয়া হয়নি; বরং এটি বহু বছরের আলোচনার ফল। কোনও নির্দিষ্ট দেশ বা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নয়, বরং সৌদি-পাকিস্তান ঐতিহাসিক ও কৌশলগত সম্পর্ককে ‘প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’ দেওয়ার জন্য এই ঘোষণা এখন প্রকাশ্যে আনা হয়েছে।
দশকের পর দশক ধরে রিয়াদ-ইসলামাবাদের সামরিক সম্পর্কের মধ্যে ছিল যৌথ সেনা প্রশিক্ষণ, বার্ষিক মহড়া, অস্ত্র উৎপাদন এবং সৌদি ভূখণ্ডে নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানি সেনা মোতায়েন। কিন্তু এবার এসএমডিএর মাধ্যমে পাকিস্তানের পরমাণু প্রতিরক্ষার ছাতার নিচে কার্যত প্রবেশ করেছে সৌদি আরব।
আর এই চুক্তির সময়টাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর আস্থার ঘাটতি এবং ক্রমবর্ধমান হুমকির মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা দৃঢ় করার প্রয়োজন— সব মিলিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে এ চুক্তিতে যেতে বাধ্য করেছে রিয়াদকে।
অবশ্য অনেক দিন ধরেই ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি ব্যাপক প্রতিরক্ষা চুক্তি অর্জন করতে চাইছিল সৌদি আরব। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার শর্তে জোর দেওয়ায় রিয়াদ পিছিয়ে আসে। গাজা যুদ্ধ আরও গভীর পর্যায়ে পৌঁছানোয় এখন সেই শর্ত রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ও প্রায় অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র শুধু অস্ত্র বিক্রি আর অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ফলে রিয়াদ বুঝেছে— ওয়াশিংটন অস্ত্র দেবে, কিন্তু প্রতিরক্ষার ছাতা দেবে না।
এর মধ্যে সংকট আরও ঘনিয়ে এসেছে। চলতি বছরই প্রতিবেশী কাতারে ইরান সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, আর কয়েক সপ্তাহ আগে দোহায় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে। এরপর জরুরি আরব-ইসলামিক সম্মেলন হলেও উপসাগরীয় দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কার্যকর কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। সেই মুহূর্তেই সৌদি আরব ইসলামাবাদের দিকে ঝুঁকেছে।
সৌদি-পাকিস্তান: পুরোনো হিসাব, নতুন বাস্তবতা
পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির পেছনে সৌদি আরবের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশভাগের ধাক্কা সামলে ঘোষণা দেন—“ঘাস খেয়ে হলেও আমরা বোমা বানাবো”।
তখনই তিনি সৌদি বাদশাহ ফয়সালের কাছে সহায়তা চান এবং রিয়াদ গোপনে সেই সহায়তা দেয়।
১৯৯৮ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালালে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় দেশটি বিপর্যস্ত হয়। তখনও সৌদি আরব চার বছরের জন্য প্রায় ৩৪০ কোটি ডলারের তেল ঋণসুবিধা দেয়।
এ কারণেই সৌদি প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সাল একসময় বলেছিলেন—“বিশ্বে দুই দেশের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর কোথাও নেই।”
ইরানের সম্ভাব্য পারমাণবিক সক্ষমতা ঠেকাতে দীর্ঘদিন ধরেই বিকল্প খুঁজছিল সৌদি আরব। পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক এখন সেই বিকল্পকেই বাস্তব রূপ দিচ্ছে।
‘মিনি-ন্যাটো’র দিকে পথচলা?
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ইঙ্গিত দিয়েছেন, আরও দেশ হয়তো ভবিষ্যতে ইসলামাবাদের সঙ্গে একই ধরনের ব্যবস্থা চাইবে। সৌদি আরবের বিমানবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফয়সাল আল হামাদও আল-আরাবিয়াকে বলেছেন, এই চুক্তি ন্যাটোর আর্টিকেল-৫ এর মতোই মূলনীতি অনুসরণ করে— যে এক দেশের ওপর আক্রমণ মানেই সব দেশের ওপর আক্রমণ।
যদিও ন্যাটোর সঙ্গে তুলনায় এসএমডিএ এখনো সীমিত। ন্যাটোতে ৩২টি দেশ, সমন্বিত কমান্ড কাঠামো ও পারমাণবিক অস্ত্র ভাগাভাগির ব্যবস্থা রয়েছে। বিপরীতে এসএমডিএ দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, যা দীর্ঘদিনের সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।
তবুও চুক্তিটি আলোড়ন তুলেছে পাকিস্তানের খোলামেলা অবস্থানের কারণে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন—“প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রয়োজনে উন্মুক্ত থাকবে।”
বর্তমানে এটিকে অনেকে ‘মিনি-ন্যাটো’ বললেও বাস্তবে এটি একটি নমনীয় দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, যা ভবিষ্যতে অন্য দেশ — যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত বা মিসর — যুক্ত হলে নতুন আকার পেতে পারে।
অবশ্য সৌদি আরব কি পাকিস্তানের ওপর ভর করে নিজেকে ইরান, মার্কিন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও আঞ্চলিক বিশৃঙ্খলা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে? সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির পরবর্তী অধ্যায় অনেকাংশে নির্ভর করছে এই বাজির ওপর।
S