বর্তমান যুগে চাকরি যেন এক সোনার হরিণ। পড়াশোনা শেষে এক যুদ্ধ অতিক্রম করে চাকরি পাওয়া যেন এক দীর্ঘ সফর। তবে এই লড়াইয়ের পাশাপাশি এখন চোখে পড়ে ভিন্ন কিছু দৃশ্য। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের সাবলম্বী করতে বেছে নিয়েছেন নতুন কিছু উদ্যোগ, যা তাদের মনবল বাড়াতেও সাহায্য করছে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সাম্প্রতিক সময়ে এক ভিন্ন ধরণের চিত্র চোখে পড়ে। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট আর সেমিস্টার পরীক্ষার চাপের মাঝেও বেশ কিছু শিক্ষার্থী নিজেদের উদ্যোগে ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন। নীরবে-নীরবে একটা নতুন প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা। কেউবা শুরু করেছেন খাবারের ব্যবসা আবার কেউ পোশাক বা প্রসাধনী।
হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য থেকে বাহারি সুস্বাদু সব খাবার, বিকেল হলেই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফট সেজে উঠে নানান উদ্যোক্তার সৃজনশীলতায়। এসব কাজ যেমন তাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করছে পাশাপাশি বৃদ্ধি করছে তাদের মনবল।
জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এক ছাত্রী শুরু করেছেন প্রসাধনীর কাজ। তিনি শুরু করেছিলেন খুব সাধারণভাবে। নিজের বানানো কয়েকটি ব্রেসলেট সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন। কয়েকজন সহপাঠীর আগ্রহ দেখার পর তিনি নিয়মিত অর্ডার নিতে শুরু করেন। হলের ছোট টেবিলটিই তার কারখানা। রাতের নীরবতায় তিনি নতুন ডিজাইন তৈরি করেন, সকালে ক্লাসে যাওয়ার আগে প্যাকেট গুছিয়ে রাখেন। তার ভাষায়, “আমি আগে ভাবতাম ব্যবসা শুধু টাকাওয়ালারা করে। এখন দেখি ইচ্ছে থাকলেই শুরু করা যায়।”
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রাসেল শুরু করেছেন নিজের ছোট একটি ফুড কার্ট যেখানে তিনি রেখেছেন বাহারি সুস্বাদু খাবার। রেস্টুরেন্টের খাবারের মূল্য চড়া হওয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য এই ফুড কার্ট হয়ে উঠেছে ভরসার স্থল। স্বাস্থ্যকর খাবার, পাশাপাশি সুন্দর সজ্জা, প্রত্যেক ক্রেতারই মনোযোগ আকর্ষণ করতে বাধ্য।
আরেকদিকে, ভুগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোশারফ হোসেন শেখ শুরু করেছেন বিভিন্ন ধরনের পোশাকের ছোট একটা ব্যবসা। আসন্ন শীতকে কেন্দ্র করে বাহারি সব শীতের পোশাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতের নাগালে দিতে পেরে তিনিও আনন্দিত।
এদের পাশাপাশি আরও অনেক শিক্ষার্থী হিজাব, শাল, সেলাইয়ের কাজ, ডিজিটাল আর্ট, ফটো এডিটিং, এমনকি অনলাইন টিউশনি সব মিলিয়ে নানা ধরনের উদ্যোগে যুক্ত হচ্ছেন। প্রত্যেকে নিজের মতো করে দক্ষতা ব্যবহার করছেন। কারো কাছে ব্যবসা শুরু করার মূল কারণ অর্থনৈতিক চাপ, কারো কাছে নিজের স্বাধীনতা দেখানোর ইচ্ছা, কারো কাছে আবার ভবিষ্যতে বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন।
শিক্ষকরা বলছেন, এই পরিবর্তনের পেছনে দুইটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সহজলভ্যতা এবং ছাত্রীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বৃদ্ধি। একজন শিক্ষক মন্তব্য করেন, “আগে ছেলেমেয়েরা চাকরির কথা ভেবে পড়াশোনা করত। এখন তারা বুঝছে নিজস্ব উদ্যোগও ক্যারিয়ারের বড় অংশ হতে পারে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশও তাদের অনুপ্রাণিত করছে। ক্যাম্পাসে ছোট ছোট নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। কেউ নতুন পেজ খুললে বন্ধুদের শেয়ার, কেউ ডেলিভারি নিয়ে পরামর্শ, কেউ আবার প্রোডাক্টের ছবি তুলে সাহায্য করে। ফলে উদ্যোগ শুরু করা এখন আর একা লড়াই নয় বরং সমবায়ী সহায়তায় এগিয়ে যাওয়া।
পরিবারগুলোর মনোভাবেও পরিবর্তন এসেছে। অনেক বাবা-মা মেনে নিচ্ছেন যে মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি আয়ের পথ তৈরি করতে পারে এবং সেই আয় তাদেরই আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। কিছু পরিবার শুরুতে সন্দেহ করলেও পরে সন্তানের সাফল্য দেখে সমর্থন দিয়েছে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাই শুধু শিক্ষার্থী নয় তারা ভবিষ্যতের নতুন উদ্যোক্তা প্রজন্ম। কেউ ছোট পরিসরে শুরু করছে, কেউ ধীরে ধীরে গ্রাহক বাড়াচ্ছে, কেউ আবার নিজের কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্য ছাত্রীদের উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের প্রতিদিনের পরিশ্রমের ভেতর লুকিয়ে আছে নতুন সম্ভাবনা, নিজের জায়গা তৈরি করার ইচ্ছা এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে হাঁটলে তাই এখন আর শুধু বইয়ের শব্দ কিংবা ক্লাসের তাড়া শোনা যায় না। শোনা যায় আর্থিক স্বাধীনতার স্বপ্ন, নিজের পরিচয় গড়ার চেষ্টায় ব্যস্ত কিছু তরুণীর নীরব অদম্য পথচলার গল্প।