বগুড়ায় বিয়ের পর সংসার টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর যত বিয়ে হচ্ছে, তার প্রায় অর্ধেকই শেষ হচ্ছে তালাকে। পরকীয়া, মাদকাসক্তি, যৌতুকের দ্বন্দ্ব, মতের অমিল, পারিবারিক অশান্তি ও আয়-ব্যয়ের বিরোধ—সব মিলিয়ে নতুন সংসারগুলো ভাঙনের মুখে পড়ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের মানসিক বিকাশ এবং বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা।
বগুড়া জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে জেলার ১২ উপজেলায় নতুন বিয়ে নিবন্ধিত হয়েছে ৮০ হাজার ৫২৭টি, আর একই সময়ে তালাক হয়েছে ৩৮ হাজার ৪০৮টি। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিয়ে ১৬৬৪৫টি ও তালাক ৭৮৫৫টি, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিয়ে ১৪৮৯০টি ও তালাক ৬৮৩০টি, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিয়ে ১৫০৮০টি ও তালাক ৭৩৫৫টি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিয়ে ১৫০৮০টি ও তালাক ৭৩৫৫টি।
পরিসংখ্যান বলছে, তালাকের আবেদনকারীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামে তালাকের হার সবচেয়ে বেশি। গ্রামাঞ্চলে মূলত স্বামীদের মাদক সেবন ও জুয়ায় আসক্তি সংসার ভাঙনের বড় কারণ।
চিকাশী ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজি মো. সুজন মিয়া বলেন, অনেক স্বামী জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। এরপর সংসারের ব্যয় বহন করতে না পারায় সম্পর্ক ভেঙে যায়। আর শহরাঞ্চলে অহংবোধ, পরকীয়া, নারীদের অতিরিক্ত জেদ ও সম্পর্কের টানাপোড়েনই বিচ্ছেদের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বগুড়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাসরিন জাহান জেরিন বলেন, নেশা ও পরকীয়া এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পাশাপাশি নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন, এতে ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি কখনো অহংবোধও জন্ম নিচ্ছে, যা দাম্পত্য সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।
শিশু আদালতের পিপি ও সমাজকর্মী সুফিয়া বেগম বলেন, বাবা-মার বিচ্ছেদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সন্তানের। সে হয় মায়ের কাছে থেকে বাবাকে হারায়, নয়তো বাবার কাছে থেকে মায়ের স্নেহ পায় না। এতে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
বগুড়া জেলার সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল হান্নান বলেন, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া, যৌথ পরিবারের অভাব এবং নারীর আর্থিক স্বাধীনতা—সব মিলিয়েই তালাকের হার বেড়েছে।
বগুড়া জেলা রেজিস্ট্রার সিরাজুল করিম বলেন, নারীরা এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানেন, তাই তালাকের ঘটনাও বাড়ছে। তবে সংসার ভেঙে গেলে সন্তানের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকা জরুরি।
সুশীল সমাজের মতে, সম্পর্ক রক্ষায় স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া ও সহমর্মিতা বাড়াতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ, পারিবারিক ঐক্য ও সামাজিক বন্ধনকে পুনরুজ্জীবিত করতে না পারলে এই প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে না।
বগুড়ায় প্রতি দুটি নতুন বিয়ের একটি ভেঙে যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি শুধু পারিবারিক নয়, সামাজিক সংকটের ইঙ্গিত। সম্পর্কের টানাপোড়েন, মাদকাসক্তি ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ না হলে এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
S